Breaking

Sunday 24 July 2022

তানজিমাত কী ? তানজিমাত যুগে অটোমান তুরস্কে গৃহীত সংষ্কারাবলী কী ছিল (What is Tanzimat? What are the reforms adopted in Ottoman Turkey during the Tanzimat movement?

 তানজিমাত কী ? তানজিমাত যুগে অটোমান তুরস্কে গৃহীত সংষ্কারাবলী কী ছিল ?

                                                                                      

তানজিমাত তুরস্ক সরকারের একটি সংস্কারবাদী আন্দোলন। মধ্যযুগীয় সমাজ ব্যবস্থা থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণের একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ হিসেবে তানজিমাত বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তুরস্কের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামরিক, অর্থনৈতিক এবং শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক দুর্বলতা যখন সা¤্রাজ্যের পতন তরান্বিত করেছিলো তখন তানজিমাত আন্দোলন সাময়িকভাবে এই পতনের গতি রোধ করেছিলো। উসমানীয় সাম্রাজ্যকে আধুনিক করে তোলার প্রচেষ্টা, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে প্রশমিত করা এবং আগ্রাসী শক্তি থেকে সাম্রাজ্যের সীমানার সুরক্ষাসহ আরো অনেক কাজের জন্য এই সময়কালটি গুরুত্বপূর্ণ। 


ক. তানজিমাতের সংজ্ঞা:

তানজিমাত শব্দের অর্থ সংস্কার, পুর্নগঠন এবং নীতিমালা। সাধারণত ১৮৩৯ সালে সুলতান আব্দুল মজিদ তুরস্কে যে সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন মূলত তাকেই তানজিমাত বলা হয়। তানজিমাত হলো কতগুলো নীতিমালার সমষ্টি যেগুলোর মাধ্যমে অটোমান তুরস্ক মধ্যযুগীয় ব্যবস্থা থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণের চেষ্টা করেছে।

অথবা, তুরস্কে স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের স্থলে প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য উনবিংশ শতাব্দির মধ্যভাগে যে আন্দোলন শুরু হয় তাকেই তানজিমাত বলে। 








খ. তানজিমাতের প্রেক্ষাপট/কারণ:


  1. বহুজাতিক তুরস্ক;

  2. সামরিক বাহিনীর দুর্বলতা;

  3. তুর্কি শাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ;

  4. কুচুক কাইনারজির সন্ধির বিরুদ্ধে জনগনের প্রতিক্রিয়া;

  5. পরাশক্তিগুলোর সা¤্রাজ্যবাদী নীতি ;


গ. তানজিমাতের সূচনা পর্ব: 

১৭৭৪ -১৮৩৯ পযর্ন্ত ছিলো তানজিমাতের সূচনা পর্ব। এ সময় কুচুক কাইনারজির সন্ধি, ফরাসি বিপ্লব, নেপোলিয়নের মিসর আক্রমন, গ্রিসের স্বাধীনতা ইত্যাদি ঘটনাগুলোর কারণে সুলতানগন সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করেছিলে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংস্কারের সূচনা করেছিলেন। যে সকল সুলতানরা তুরস্কে তানজিমাতের সূচনা করেছিলেন তারা হলেন-


  1. প্রথম আব্দুল হামিদ (১৭৭৪-১৭৮৯)

  2. তৃতীয় সেলিম (১৭৮৯-১৮০৭)

  3. দ্বিতীয় মাহমুদ (১৮০৯-১৮৩৯)


ঘ. তানজিমাতের মূল পর্ব (১৮৩৯-১৮৬১):

এ সময় তানজিমাতের প্রাণ পুরুষ ছিলেন প্রথম আব্দুল মজিদ। আর তাকে যারা সহায়তা 

করেছেন  তারা হলেন-

  1. আলী পাশা

  2. রশিদ পাশা

  3. ফুয়াদ পাশা

  4. মাতা ওয়ালিদা সুলতানা 


ঙ. তানজিমাতের রাজকীয় ঘোষনা:

সুলতান প্রথম আব্দুল মজিদ কর্তৃক প্রদত্ত তিনটি রাজকীয় ঘোষনাই মূলত তানজিমাত নামে পরিচিত। এগুলো হলো-


  • খাত্তি শরিফ গুলহান-১৮৩৯

  • খাত্তি হুমায়ূন- ১৮৪০

  • খাত্তি হুমায়ূন- ১৮৫৬ 





চ. তানজিমাতের বৈশিষ্টসমূহ:

তিনটি রাজকীয় ঘোষণার আলোকে তুরস্কে যে সকল সংস্কার সাধিত হয় সে গুলো হলো-


  1. জানমালের নিরাপত্তা:

১৮৪০ সালের ঘোষণায় উসমানীয় প্রজাদেরকে তাদের জীবন, সম্মান ও সম্পদের পূর্ণ নিরাপত্তা দানের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়।  জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সাধারণ উসমানীয় নাগরিকত্ব বিষয়ক জাতীয়তা আইন ১৮৬৯ প্রণয়ন করা হয়। এই নীতি উসমানীয় শাসনাধিন অঞ্চলের সকল জনগণ, মুসলিম, অমুসলিম; তুর্কি, গ্রিক; আর্মেনীয়, ইহুদি, কুর্দি, আরব সবার মধ্যে একতার বিষয়টি প্রাধান্য দেয়।


  1. ধর্মীয় স্বাধীনতা:

মুসলিমরা শরীয়াহ, খ্রিষ্টানরা ক্যানন ও ইহুদিরা হালাকা আইন অনুযায়ী চলত। ১৮৩৯ সালের  ফরমানে সকল ধর্মের নাগরিকদের জন্য আইনের দৃষ্টিতে পূর্ণ সমানাধিকারের ঘোষণা দেয়া হয়। কাউকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা এবং ইসলাম ত্যাগের জন্য মৃত্যুদন্ড দেয়াকে অবৈধ করা হয় । স্বাধীন ভাবে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠাণ পালনের এবং মতামাত প্রকাশের পথ সুগম হয়।


  1. আইন ও বিচার ব্যবস্থার সংস্কার: 

মজলিস-ই মারিফ-ই উমুমনিয়া প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা ছিল প্রথম উসমানীয় সংসদের আদিরূপ। ফরাসি রীতিতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনের পুনর্গঠন করা হয়। ইউরোপীয় রীতির  আদালত এবং সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হয়। নির্দিষ্ট অভিযোগ ব্যতিত কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার বা বিনা বিচারে দন্ড না দেওয়ার বিধান করা হয়। 


  1. সামরিক সংস্কার: 

ফরাসি রীতিতে সামরিক সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়। সামরিক সামন্তবাদের বিলোপ সাধন করে সরাসরি বেতনভুক্ত সামরিক বাহিনী গঠন করা হয়। সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন এবং বাহিনীতে যোগদান, অবসর ও চাকরির মেয়াদকাল নির্দিষ্ট করার নিয়মিত পদ্ধতি চালু  করা হয়। জেনিসারি বাহিনীর বিলুপ্তি সাধন করা হয়। অমুসলিমদেরকে সৈনিক হওয়ার অনুমতি দান করা হয় ।


  1. অর্থনীতি ও ব্যাংক ব্যবস্থা:  

ফরাসি রীতিতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন  করা হয়। উসমানীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং উসমানীয় স্টক এক্সচেঞ্জ  প্রতিষ্ঠা  করা হয়। প্রথম উসমানীয় ব্যাংক নোটের প্রচলন করা হয় এবং অর্থনৈতিক ও রাজনীতি বিজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষালয় চালু করা হয়।


  1. সামাজিক সংস্কার:

তুর্কি সমাজ থেকে দাসপ্রথা ও দাস ব্যবসার বিলুপ্তি সাধন করা হয়। প্রথম উসমানীয় আদমশুমারি সম্পাদন করা হয়, এতে শুধু পুরুষদের গণনা করা হয়েছিলো।


  1. জাতীয় বিষয়াবলি: 

১৮৪৪ সালে প্রথম জাতীয় পরিচয় পত্রের প্রচলন করা হয়। উসমানীয় জাতীয় সঙ্গীত ও উসমানীয় জাতীয় পতাকার  প্রচলন করা হয়।


  1. শিক্ষা ব্যবস্থা:

কাউন্সিল অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় চালু করা হয়। প্রথম আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়, একাডেমী, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। তুর্কি যুবকদেরকে উচ্চ শিক্ষার জন্য ইউরোপের বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ে  প্রেরণ করা হয়। বিজ্ঞান একাডেমী প্রতিষ্ঠা করা হয়।


  1. কর ব্যবস্থার সংস্কার:

জায়গীরদারি প্রথা বাতিল করে ভূমি জরিপ ও বন্টন করে কর আদায়ের ব্যবস্থা করেন। অমুসলিমদের উপর থেকে জিজিয়া কর বিলুপ্ত করে কর সংগ্রহের একটি নিয়মিত পদ্ধতি প্রণয়ন করা হয়।


  1. যোগাযোগ ব্যবস্থা: 

প্রথম বাস্পচালিত ফেরী চালনা শুরু হয়, ১৮৪০ সালে ডাক ব্যবস্থায় সাম্রাজ্যে প্রথম ডাকঘরের প্রচলন করা হয়। সর্বপ্রথম টেলিগ্রাফ ও রেলপথ চালু করা হয়।


  1. অমুসলিমদের সুযোগ-সুবিধা:

১৮৫৬ সালে অমুসলিমদেরকে জিজিয়া কর থেকে মুক্তি দেয়া হয়, সেনা বাহিনীতে নিয়োগ ও যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকুরি লাভের সুযোগ দেয়া হয়। খ্রিস্টান ধর্ম-যাজকগণ সরকারের তহবিল থেকে ভাতা পেতেন। তারা ঘর-বাড়ী,গীর্জা,হাসপাতাল,স্কুল ও সমাধিস্থল নির্মাণ ও সংস্কার করার অধিকার লাভ করে।




  1. সরকারি নিয়োগ: 

জাতি,ধর্ম,বর্ণ,ভাষার ভিত্তিতে নয় বরং যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার আলোকেই সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেয়া হবে মর্মে সুলতান আব্দুল মজিদ নির্দেশ দেন। অমুসলিমদের অসন্তোষ দূরিকরণে এটা ছিলো খুবই জরুরি।


  1. প্রশাসনিক সংস্কার:

১৮৪০ সালের খাত্তি  হুমায়ূনের ফরমানের  আলোকে রশিদ পাশা ফরাসি আদলে প্রশাসনিক কাঠামো বিন্যাস করেন। বিভিন্ন দপ্তর সৃষ্টি করে বেতনভুক্ত  রাজকর্মচারী নিয়োগ দেন। ইস্তাম্বুলের জন্য আধুনিক মিউনিসিপেলটি এবং নগর পরিকল্পনা কাউন্সিল গঠন করা হয়। এতে সুলতানের স্বৈরাচারী ক্ষমতা হ্রাস পায়।


  1. গণমাধ্যম:

১৮৫৭ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রকাশনা ও ছাপাখানা চালুর অনুমতি দান এবং ১৮৬৪ সালে প্রেস এন্ড জার্নালিজম রেগুলেশন কোড প্রণয়ন করা হয় ।

      

  1.  ভূমি আইন: 

১৮৫৮ উসমানীয় ভূমি আইন প্রণয়ন করা হয়, এ আইন অনুযায়ী ভূমির মালিকানার কাঠামো পরিবর্তনের ফলে রাশিয়ান ইহুদীরা ফিলিস্তিনে জমি কেনার অনুমতি পায় যা ফিলিস্তিনে তাদের পুনর্বাসনে সক্ষম করে তোলে। ভুমি আইনের মাধ্যমে অমুসলিমরাই বেশি সুবিধা পায়।


  1.  বিবিধ-

  1. ১৮৫০ সালে স্বাস্থ্যসেবা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়; 

  2. ১৮৫০ সালে ব্যবসা ও বাণিজ্য বিধি জারি করা হয়; 

  3. ১৮৪০ এবং ১৮৫৮ সালে ফরাসি আদলে দন্ডবিধি আইন প্রবর্তন করা হয়। 





ছ. তানজিমাতের সফলতা/ফলাফল:


  1. তানজিমাত আন্দোলনের মাধ্যমে তুর্কি শাসকশ্রেণী ও জনগনের মাঝে মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের সূচনা হয়।

  2. অমুসলিম সম্প্রদায়ের বৈরিতাপূর্ণ মনোভাব দূর হয়।

  3. জাতি,ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এক আইনের অধীনে চলে আসে।

  4. অটোমান সাম্রাজ্যে আধুনিকায়নের শুভ সূচনা হয়।

  5. অল্প পরিসরে হলেও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়।

  6. শিক্ষা ক্ষেত্রে এর প্রভাব ছিলো বেশি। নব্য উসমানীয় এবং নব্য তুর্কি আন্দোলন ছিলো তানজিমাতেরই ফসল।

  7. তানজিমাত অটোমান সাম্রাজ্যের দ্রুত পতনকে রোধ করেছিলো।


জ. তানজিমাতের ব্যর্থতা:


তানজিমাত সফলতার তুলনায় ব্যর্থতাই ছিলো বেশি; যেমন-

  1. কিছু শর্ত ও আর্দশ বাস্তবায়ন করা হলেও বেশির ভাগ সংস্কার প্রকল্প ছিলো ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।


  1. এটা মুসলিম -অমুলিমদের সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে। কেননা গোড়া মুসলিমরা অমুসলিমদেরকে দেয়া বিশেষ সুবিধা মেনে নিতে পারেনি।


  1. ইউরোপীয় শক্তিবর্গের সহায়তা ও অনুপ্রেরণায় খ্রিস্টানরা সুবিধা পাওয়ার চেয়ে স্বাধীনতায় আগ্রহী ছিলো বেশি।

  2. অটোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে জাতীয়তাবাদের উত্থান তানজিমাতকে ব্যর্থ করেছিলো।


  1. তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলোর হস্তক্ষেপ এবং রাশিয়ার আগ্রাসন নীতি সর্বদাই তুরস্ককে বিচলিত রেখেছে। যা তানজিমাত ব্যর্থতার অন্যতম কারণ।


  1. উলেমা শ্রেণী পাশ্চাত্য ভাবধারাকে মেনে নিতে পারেনি। তারা এর বিরুদ্ধাচারণ করেছে।


  1. সর্বোপরি এত সল্প সময়ে একটি সাম্রাজ্যকে আমূল পরিবর্তণ করার মত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, দক্ষ জনশক্তি এবং সামর্থ তুর্কি সুলতানের ছিলনা, ফলে তানজিমাত অনেকাংশেই ব্যর্থ হয়েছে।









Md. Billal Hossain

B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka

BCS General Education

Lecturer

Department of Islamic History & Culture

Chandpur Govt. College, Chandpur.






No comments:

Post a Comment